1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর সম্পর্কে তথ্যে ভুল আছে : মেজর রফিক

৮ ডিসেম্বর ২০১০

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেক্টর ১ এর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম৷ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গড়া এই সেক্টরে সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন এই সেনা৷ পেয়েছেন ‘বীর উত্তম’ খেতাব৷

https://p.dw.com/p/QSvK
অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলামছবি: bdnews24.com/Mustafiz Mamun

১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চই বিদ্রোহ শুরু করেন মেজর রফিকুল ইসলাম৷ সেসময় চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর অ্যাডজুটান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি৷ তখনই বুঝে গিয়েছিলেন দেশকে বাঁচাতে চাইলে যুদ্ধের বিকল্প নেই৷ তাই আগেভাগেই চট্টগ্রামের সীমান্ত এলাকার দখল নিতে শুরু করে তাঁর সেনারা৷ ডয়চে ভেলেকে ২৪ মার্চের সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে রফিক বলেন, ২৪শে মার্চ দিনের বেলা পশ্চিমারা খুব কৌশলে চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ারকে ঢাকা নিয়ে যান৷ এরপর চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হয় একজন অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে৷ এসময় চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত নামে একটি জাহাজে ১০ হাজার মেট্রিন টন অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুদ ছিল৷ আমরা নিশ্চিত ছিলাম এই অস্ত্র গোলাবারুদ বাঙালিদের হত্যার কাজেই ব্যবহার করা হবে৷

রফিক বলেন, পশ্চিমা ব্রিগেডিয়ার দায়িত্ব নিয়েই এই অস্ত্র গোলাবারুদ খালাসের নির্দেশ দেন৷ এবং যারা বাধা দিচ্ছিল তাদেরকে গুলি করে হত্যা করেন৷ আমরা বন্দরে গোলাগুলির আওয়াজ শুনছিলাম৷ তখনই আমি বুঝতে পারি, ওরা আমাদের উপর গণহত্যার কার্যক্রম এবং আমাদের ওপর আক্রমণ যেকোন সময় শুরু করবে৷ আমি তাই, সীমান্তে আমার অনুগত সেনাদেরকে যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেই৷

চট্টগ্রাম দখল

২৫শে মার্চ যুদ্ধ শুরুর পর সঙ্গে থাকা সেনাদের নিয়েই চট্টগ্রাম শহর দখল করে ফেলেন মেজর রফিক৷ কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হয় তাকে৷ রফিকের দাবি, কোন এক কারণে সেসময় আরেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়া সহযোগিতা করেননি তাকে৷ তিনি বলেন, তাকে (মেজর জিয়া) যখন আমরা মেসেজ পাঠালাম, যে আমরা যুদ্ধ শুরু করেছি৷ তখন এই মেসেজ পেয়ে আগ্রাবাদ এলাকা থেকে তিনি ফেরত আসেন৷ এসে শহরের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ না করে, কোন কারণেই হোক, সেটা আমি জানি না, উনি তাঁর এইট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য এবং অন্যদের নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে কর্ণফুলী নদী পেরিয়ে কক্সবাজারের দিকে চলে যান৷

Bangladesh Unabhängigkeitsbewegung Flash-Galerie
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নানা বইছবি: Public domain

মেজর জিয়ার অসহযোগিতা

এই চলে যাওয়া খানিকটা অসহায় করে দেয় মেজর রফিককে৷ সেই ঘটনা এখনো পরিস্কারই মনে করতে পারেন তিনি৷ মেজর বলেন, উনি (মেজর জিয়া) চলে যাওয়ার ফলে আমার কাপ্তাই থেকে যে সৈন্যগুলো আসছিল, ইপিআর এর, এই সৈন্যরা শহরের কাছাকাছি এসে দেখলো যে, বেশকিছু বাঙালি সৈন্য শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ তখন তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হল৷ সেদলের ক্যাপ্টেন হারুন তখন শহর ছেড়ে যাওয়া অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন৷ হারুন আমাকে পরে জানালেন যে, জিয়াউর রহমান সাহেব এবং অন্যরা তাকে বলেছে শহরে কেউ নেই৷ এজন্য তারা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে নদীর অপর পাড়ে চলে যাচ্ছে৷ তখন হারুনও দলসহ তাদের সঙ্গে চলে যান৷ ফলে আমি আমার কাঙ্খিত সৈন্যদের না পাওয়াতে শহর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি৷

সেক্টর নিয়ে ভুল তথ্য

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পর্কে ডয়চে ভেলেকে সম্পূর্ণ নতুন এক তথ্য দিলেন মেজর রফিক৷ ১৯৭১ সালে দেশকে বিভিন্ন সেক্টর ভাগ করা হয়েছিল জুলাই মাস থেকে, তার আগে নয়৷ তিনি জানান, ১০ থেকে ১৭ জুলাই কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সেই সম্মেলনেই নির্ধারন করা হয়, বাংলাদেশকে কয়েটি সেক্টরে ভাগ করা হবে, কে কে সেক্টর কমান্ডার হবেন, কয়টা ব্রিগেড তৈরি হবে, কোনটার কমান্ডার কে হবেন৷ মেজর রফিক বলেন, আসলে সেক্টর ফর্মড হয় জুলাই মাসে, তার আগে সেক্টর কমান্ডার কার্যত কেউ ছিলেন না৷

সেই বৃদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধে ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই বীর সেনা৷ বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এবং নোয়াখালী জেলার মুহুরী নদী পর্যন্ত সমগ্র এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টর৷ ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ১২ মাইল দূরে ছিল তাঁর সেনারা৷ কুমিরা এলাকা তখন দখল হয়ে গেছে৷ দ্রুত পৌঁছাতে হবে চট্টগ্রাম৷ কেননা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গেছে মার্কিন সপ্তম নৌ বহর৷ তখন রফিকের সঙ্গে দেখা হলো এক বৃদ্ধার৷ সেই রাতের অভিজ্ঞতা আজও ভুলতে পারেন না রফিক৷ তিনি বলেন, আমাদের চট্টগ্রাম দখলের তাড়া ছিল৷ কিন্তু একটি সেতু ভাঙা থাকায় খাল ভরাট করে যানবাহন পাড় করতে হচ্ছিল৷

সেসময় এক বৃদ্ধা এসে আমাদেরকে বললেন, বাবারা তোমরা খালটা ভরে গাড়ি পাড়ের জন্য সময় নষ্ট করোনা৷ তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা তোমাদের গাড়ি পাড় করিয়ে দেবো৷ পাশের পাহাড় দিয়ে আমরা পাথর নিয়ে আসবো৷ তাতেও বিলম্ব হলে আমরা নিজেরাই খালে শুয়ে পড়বো৷ তার ওপর গাড়ি দিয়ে চালিয়ে যেও তোমরা৷ তারপরও তারাতারি যাও৷ যত দ্রুত যেতে পারো শহরে ততই আরো বাঙালির জীবন বাঁচানো যাবে৷ বলাবাহুল্য বৃদ্ধাদের শরীরের ওপর দিয়ে গাড়ি চালায়নি মেজর রফিকের দল৷ তবে চট্টগ্রাম দখলে তাঁর সাহসিকতা সত্যিই অতুলনীয়৷

বিজয় কেতন

সতেরই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিজয় কেতন ওড়ান মেজর রফিকুল ইসলাম৷ মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য বীর উত্তম খেতাব পান তিনি৷ কিন্তু তারপরও ৭২ সালেই সেনাবাহিনী থেকে সরে যেতে হলো তাকে৷ এর কারণ আজও জানাতে চান না অভিমানী এই বিজয়ী সেনা৷ তিনি বলেন, কোন এক কারণে আমাকে অবসর নিতে হয়েছিল৷ সেই কারণ হয়তো কোন একদিন আমি লিখে যাবো৷ কিন্তু এখন বলতে চাইছিনা৷

রাজনীতিতে রফিক

মেজর রফিক সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন ১৯৯৬ সালে৷ বর্তমানে হাজিগঞ্জ শাহরাস্তি এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তিনি৷ দেশ গড়ার এই কারিগরের কাছে জানতে চাই, ৪০ বছরে কতটা আগালো স্বাধীন বাংলাদেশ? রফিক কিন্তু বেশ আশাবাদী৷ তিনি বলেন, দেশ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন ভালো৷ অনেকেই হয়তো এটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবেন৷ কেননা রাজনীতি অস্থিরতা চলছে৷ রফিক বলেন, রাজনীতিতে অস্থিরতা থাকতে পারে, কিন্তু আমি দেখছি এসব কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে৷

প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক