1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে মুসলমানদের যোগাভ্যাস নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্ক

৩ এপ্রিল ২০০৯

সারা বিশ্বেই আজ যোগাসনের কদর৷ ইউরোপে, অ্যামেরিকায় মানসিক শান্তির জন্য এবং দেহের শ্রীর জন্য যোগাভ্যাসের শরণ নিচ্ছেন আজকাল বহু মানুষ৷ কিন্তু কট্টর মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই নাকি যোগ-ব্যায়ামের বিরোধী৷ অন্ততপক্ষে ভারতে৷

https://p.dw.com/p/HPSh
যোগ ব্যায়ামরত এক সাধুছবি: AP

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ফতোয়া কাউন্সিলও মুসলমানদের জন্য শুধু যে যোগাভ্যাস নিষিদ্ধ করেছে - তাই নয়, যোগ-ব্যায়াম বা যোগাসনকে ইসলামের জন্য হারাম বলে একটি ফতোয়াও জারি করেছে৷ মালয়েশিয়ার এক ধর্মীয় নেতা জানান, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীন এই শরীর চর্চার পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারবেন না৷ তাঁর কথায় যোগ-ব্যায়াম নাকি ইসলাম বিরুদ্ধ৷

মালয়েশিয়াতে এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু, যোগ-ব্যায়ামের উৎস যে দেশটিতে, অর্থাৎ ভারতবর্ষেও, এই শরীর চর্চার পদ্ধতিটিকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানা রকম আলোচনা৷ ভারতীয় মুসলমানদের জন্যও তাই এবার যোগ-ব্যায়াম নিষিদ্ধ করার কথা উঠেছে৷ যোগ সাধনার ক্ষেত্রে গোঁড়া মুসলমানদের জন্য মূল সমস্যাটা দেখা দিয়েছে ওম ধ্বনিটাকে ঘিরে৷

যোগাভ্যাসের সঙ্গে ওম ধ্বনির নিবিড় যোগ৷ যোগ-ব্যায়ামের সময় অংশগ্রহণকারীদের দেহ এবং মনকে একধরণের প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিকতার জগতে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কিন্তু, কিছু মুসলিম ধর্মীয় নেতা এই ওম ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না৷ আর তাই, তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্য যোগ-অভ্যাস নিষিদ্ধ করতে আগ্রহী৷

ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধি ড. তসলিম আহমেদ জানান : ওম শব্দটি মূলত হিন্দুধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ ফলে ব্যাপারটাকে আমরা উপোক্ষা করতে পারি না৷ এর সঙ্গে পুরোপুরি হিন্দুধর্মের যোগ৷ অন্যান্য ধর্ম ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারে না৷ এ হলো গিয়ে হিন্দুধর্মের পক্ষে একটি প্রচার৷

Frauen während Yoga im Iran
ইরানের মত দেশেও মেয়েরা যোগ ব্যায়াম করে থাকেছবি: DW

সংস্কৃত যুজ শব্দটি থেকে যোগ শব্দের উত্পত্তি৷ আর ওম হল অ (= বিষ্ণু) + উ (= শিব) + ম্ (= ব্রহ্মা) এই তিন সাংকেতিক অক্ষরের সমাহার৷ সকল মন্ত্রের আদি মন্ত্র৷ বলা হয়ে থাকে, মনের আবেগ এবং উত্তেজনাকে বশ করতে যোগাসন খুব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে৷ এছাড়া, যোগের সাহায্যে স্নায়ুবিক চাপকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ মনে ফুর্তি আসে, কাজের স্পৃহাও বাড়ে৷ তাই দীর্ঘদিন যোগাসন করলে মনে পজিটিভ এনার্জীর সঞ্চার হয়৷ যার প্রতিফলন এসে পড়ে দৈনন্দিন জীবনেও৷ যোগ ব্যায়ামের প্রবক্তারা সেকথাই বলে থাকে৷ আর ওম-কে দেখা হয়ে থাকে সকল ধ্বনির আদি বীজ হিসেবে৷

তাই ওম কথাটিকে একটি ধ্বনির বেশি ভাবতে চান না ভারতের বিখ্যাত যোগ-গুরু বাবা রামদেব৷ তাঁর কথায় : ওম হলো একটি ধ্বনি মাত্র৷ আমাদের মুসলমান ভাইদের মধ্যে কারোর যদি এই ধ্বনি উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়, তাহলে তারা ওমের জায়গায় আল্লাহ ব্যবহার করতে পারেন৷ অথবা ঈশ্বরও বলতে পারেন৷

কিন্তু তাতেও যে সমস্যা ! ধরুন, যোগাসনের একটি ক্লাসে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করছে৷ এখন শুরুতে ধ্যান করার সময় কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বী যদি সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওম বলার জায়গায় আল্লাহ বলে ওঠেন, তাহলে তার ফল কিন্তু অস্বস্তিকরও হতে পারে৷ তার ওপর, ওম এবং আল্লাহ শব্দ বা ধ্বনি হিসেবে তো একরকম নয়৷ ওম ধ্বনিটি উঠে আসে নাভি থেকে৷ এর সে জন্যই এই ধ্বনিটি মানব দেহে একটি আলাদা মাত্রা এনে দেয়৷

Guerilla Yoga auf Hawaii
পৃথিবীর বহু দেশে যোগ ব্যায়াম জনপ্রিয়ছবি: AP

তাহলে? ওম-এর জায়গায় কি ধরণের শব্দ বা ধ্বনি ব্যবহার করবে মুসলমানরা ? ভারতের মুসলিম পারিবারিক আইন বিষয়ক সংগঠনের মুখপাত্র কামাল ফারুকি জানান : ক্রীড়া চর্চা হিসেবে যোগাভ্যাসের বিরাট এক ভূমিকা আছে৷ এটাকে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে আমি প্রস্তুত নই৷ বাবা রামদেবের সঙ্গে আমি একমত৷ মুসলিমরা ওম ব্যবহার না করে, বরং অন্য ধ্বনি ব্যবহার করুক৷

ভারতের বাইরে, বিশেষ করে জার্মানিতে এবং ইউরোপের আরো কিছু দেশে নানা ধরণের সঙ্গীতের সঙ্গেও যোগাভ্যাসের চর্চা চালু৷ তাঁরা যদিও জন্মসূত্রে খ্রিস্টান, যোগ করেন যখন ধর্মের কথা ভেবে করেন না৷ কখনও ওম ব্যবহার করেন, কখনও করেন না৷ তাদের কাছে ব্যায়াম এবং মনোসংযোগই বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ কোন ধ্বনি নয়৷ ভারতে অবশ্য যোগাসন থেকে ওম ধ্বনিটিকে তুলে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে নি৷ সেই জন্যই কি ওম-কে ঘিরে এতো বিতর্ক ?

এখন আমরা যদি যোগাসনের পদ্ধতিগত দিকটির দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে যে আদতে দুটি উপায়ে যোগাসন করা যায়৷ একটা হল ব্যায়ামের মাধ্যমে আর অপরটি হল ধ্যানের মাধ্যমে৷ যার আধুনিক নাম কোয়ান্টাম৷ আর যোগাসনের প্রধান তিনটি মুদ্রা হলো - ক্রিয়াস, বন্ধাস এবং প্রাণায়াম৷ কথায় বলে, সঠিক পদ্ধতিতে এই আসনগুলি করলে শরীর ও মন দুই ভাল থাকে৷ তাই অনেকের মতে, ভারতের ১৫০ মুসলমান যদি ধ্যানের মাধ্যমে যোগাভ্যাস না করতে চায় - তাহলে শুধুমাত্র ব্যায়ামের মাধ্যমে যোগাসনের পথটা তো তাদের জন্য খোলাই থাকলো৷

তবে এরপরেও, ধ্যানকে কোন ধর্মের রঙে রঙিন করতে চান না যোগ-গুরু বাবা রামদেব৷ তিনি বলেন : পশ্চিমের কাছ থেকে, ইউরোপীয়দের তথা খ্রীষ্টানদের কাছ থেকে পাওয়া প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের দিকে একবার চোখ দেওয়া যাক৷ দুই রাইট ভাই বিমান তৈরি করেছিলেন৷ তারা তো খ্রিষ্টান৷ তাহলে কি আমি বলবো - যেহেতু ওরা খ্রিষ্টান, তাই আমি আর বিমানেই চড়বো না ?

আর সেখানেই যে লুকিয়ে আছে আসল প্রশ্ন৷ কারণ, ধর্ম তো শুধু ধর্ম নয়৷ সে যে এক জীবন বোধ৷ মানুষে-মানুষে সংযোগ৷ তত্ত্বের তির্যক বাকযুদ্ধকে পিছনে ফেলে মর্মের গভীরে প্রবেশ৷ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান - সব ধর্মের মানুষই যেখানে একই মানবসূত্রে বাঁধা৷ একইভাবে ঈশ্বরের নৈকট্যকামী৷ তাই যোগাসনের আধ্যাত্মিক দিকটি ইসলাম বিরোধী হয়ে যায় কেন ? ইসলামেও যে মানবতাবাদ উচ্চারিত হয়৷ সেখানেও যে বলা হয় হৃদয়ে-হৃদয়ে যোগসূত্রের কথা৷

প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ, সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারুক