ম্লাদিচের গ্রেপ্তারের পরেও বদলায়নি সার্বিয়ার সমাজ
১৬ জুলাই ২০১১১৯৯৫ সালের ১১ই জুলাই বসনীয় সার্ব জেনারেল রাতকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে এক বাহিনী প্রায় ৮,০০০ মুসলিম পুরুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে৷ ২০১০ সালের মার্চ মাসে সার্বিয়ার সংসদ প্রথম বারের মতো প্রকাশ্যে স্রব্রেনিৎসার ঘটনার নিন্দা জানায়৷ সম্প্রতি ম্লাদিচকে গ্রেপ্তার করে দ্য হেগে জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ আদালতে পাঠিয়েছে সার্বিয়ার সরকার৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এর মাধ্যমে সার্বিয়ার মানুষের মনে কি ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে? তারা কি উগ্র জাতীয়তাবাদের ভাবধারা ত্যাগ করে বহু জাতি-ধর্ম-বর্ণের ইউরোপীয় সমাজে নিজেদের স্থান করে নিতে পেরেছে?
সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে এক যুব গোষ্ঠী সেদেশে মানবাধিকারের বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে৷ এই উদ্যোগের প্রধান মায়া মিচিচ মনে করেন, সার্বিয়ার অধিকাংশ মানুষের মনোভাব তেমন বদলায় নি৷ তিনি বললেন, ‘‘রাতকো ম্লাদিচকে গত ২৬শে মে দ্য হেগে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি৷ এটা সত্যি এক বিশাল পদক্ষেপ৷ কিন্তু ২৭শে মে আমরা আবার এমন এক সমাজে ফিরে গেছি, যেমনটা ঠিক তার আগের দিন পর্যন্ত ছিল৷''
মিচিচ মনে করেন, যে সার্বিয়ার রাজনীতি ও সার্বিয়ার সংবাদ মাধ্যম ম্লাদিচের গ্রেপ্তারের আসল কারণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করেছে৷ বলা হয়েছে ম্লাদিচ আসলে উন্মাদ, তার বয়স নিয়েও কথা হয়েছে৷ কিন্তু একবারের জন্যও তাদের কথা শোনা যায় নি, যারা ম্লাদিচের নৃশংস ও অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছিলেন৷ সারাইয়েভো শহরের অবরোধ ও স্রব্রেনিৎসার গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের কথা শোনা যায় নি৷ সার্বিয়ার টেলিভিশনে স্রব্রেনিৎসার শিকার হয়েছেন, এমন কারো বক্তব্য তুলে ধরা হয় নি৷ প্রেসিডেন্ট বরিস তাদিচ সহ অনেক রাজনীতিক শুধু বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের স্বার্থেই ম্লাদিচকে প্রত্যর্পণ করা জরুরি ছিল৷
বেলগ্রেডের ইউরো-অ্যাটলান্টিক কেন্দ্রের প্রধান ইয়েলেনা মিলিচ মনে করেন, ইইউ কোনো স্পষ্ট শর্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে সার্বিয়াকে প্রার্থী হিসেবে স্বীকার করে নিলে তা হবে এক মারাত্মক ভুল৷ তাঁর মতে, ‘‘আমার মনে হয়, প্রেসিডেন্ট তাদিচ, তাঁর মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টারা দৃঢ় মনোবল ও রাজনৈতিক সাহসিকতা দেখিয়ে যদি নিজেদেরই এক প্রকৃত তদন্ত প্রক্রিয়ার সামনে ঠেলে দেন, তা হবে সঠিক দিশায় এক জোরালো পদক্ষেপ৷ রাতকো ম্লাদিচ ও তার আগে রাদোভান কারাজিচ কীভাবে এতদিন ধরে আত্মগোপন করে থাকতে পেরেছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে৷ আমার মনে হয়, পশ্চিমা দেশগুলির লাগাতার চাপ ছাড়া এটা সম্ভব হবে না৷ সার্বিয়ার জন্য এটা মোটেই কোনো সুখবর নয়৷''
সার্বিয়ায় এখনো প্রকাশ্যে এমন আত্মসমালোচনার পরিণাম মোটেই সুখকর হয় না৷ জবাবে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ভূরি-ভূরি কারণ খাড়া করেন বা অন্যান্য সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ সার্বিয়া বর্তমানে কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে, তার উদাহরণ তুলে ধরেন৷ এমনকি শিক্ষিত, উদারমনা মানুষ – যারা ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগ্রহী, তাদের মধ্যেও অনেককে বলতে শোনা যায়, সার্বিয়ার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে৷ এখনো সার্ব জাতিকে অশুভ শক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ রাতকো ম্লাদিচের মতো জেনারেলের নৃশংস কার্যকলাপ জানাজানি হওয়ার পরও অনেকে বলেন, আসলে যুদ্ধের তো অনেক দিক রয়েছে৷ হতে পারে, ম্লাদিচ যুদ্ধাপরাধী৷ কিন্তু ক্রোয়াট ও মুসলিমরাও তো কম যায় না৷ তারাও যুদ্ধের সময় অনেক অপরাধ করেছে৷
মায়া মিচিচ'এর মতো মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, এই মনোভাব মেনে নেওয়া যায় না৷ সার্বিয়া যতদিন না খোলা মনে নিজস্ব ইতিহাসের কালো অধ্যায় ও জাতি হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে কথা বলতে পারবে না, ততদিন গোটা অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ সেক্ষেত্রে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে যা ঘটেছিল, তার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন মিচিচ৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ